তাই এখন কৃষি সমস্যা যেমন জটিলতর হচ্ছে তেমনি কৃষি বিজ্ঞানীরাও উচ্চতর জ্ঞানসমৃদ্ধ কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন। পূর্বের শ্রেণিগুলােতে আমরা কৃষিকাজের নাম, সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির নাম, কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়াদি শিখেছি। নবম-দশম শ্রেণিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে জমির প্রস্তুতি, উর্বরতা বৃদ্ধি, ফসলভিত্তিক মাটির বৈশিষ্ট্য, ভূমিক্ষয়, ভূমিক্ষয়রােধ, বীজ সংরক্ষণ, রােগবালাই দমন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি বিষয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সম্পর্কে জানব।
ফসল নির্বাচন
মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন মাটি ফসল উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম। ফসল উৎপাদন মাটির বৈশিষ্ট্যের উপর পুরােপুরি নির্ভরশীল মাটিই হচ্ছে পানি ও পুষ্টির প্রাকৃতিক উৎস। সব মাটিতে সব ফসল জন্মায় না। যেমন: ধানগাছ কাদা মাটি বা কাদা দোআঁশ মাটি পছন্দ করে। অপর দিকে বাদাম বেলে বা বেলে-দোআঁশ মাটি পছন্দ করে। তবে বাংলাদেশের মাটি পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলি দ্বারা সৃষ্টি হওয়ার কারণে সব ধরনের ফসলই কমবেশি জন্মায়।বাংলাদেশের অধিকাংশ মাটিই নরম, হালকা, ধূলিময় ও কর্ষণযােগ্য। মাটি বলতে তাকেই বােঝায় যেখানে ফসল জন্মায়, বন সৃষ্টি হয় আর গবাদিপশু বিচরণ করে। একজন কৃষককে যখন মাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি ঝটপট বলে থাকেন যে ভূ-ত্বকের গভীরে যতটুকু লাঙলের ফলা পৌছে, যা ফসল। উৎপাদনের উপযােগী তাই মাটি। অর্থাৎ কৃষকের ভাষায় ভূ-পৃষ্ঠের ১৫-১৮ সেমি গভীর স্তরকে মাটি বলা হয়। অতএব, ফসল উপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য এ স্তরেই নিহিত।
আগেই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের মাটিতে অল্প বিস্তর সব ফসলই জন্মে । কিন্তু সব অঞ্চলের মাটির বৈশিষ্ট্য একরূপ নয়। তাই দেখা যায়, কোথাও ধান, কোথাও গম, কোথাও আলু আবার কোথাও পাট ভালাে হয়। নিচে বিভিন্ন ফসল উপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলাে।
চাষ উপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য সমূহ
ধান চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- কংকর ও বেলেমাটি ছাড়া সব মাটিই ধান চাষের উপযােগী। এঁটেল ও এঁটেল দোআঁশ মাটি ধান চাষের জন্য খুব ভালাে। নদ-নদীর অববাহিকা ও হাওর-বাঁওড় এলাকা যেখানে পলি জমে সেখানেও ধান ভালাে হয়।
- প্রকারভেদে উঁচু, মাঝারি, নিচু সব ধরনের জমিতেই ধানের চাষ করা যায়। যেমন, নিচু জমিতে বােরাে ও জলি আমন চাষ করা হয়।
- মাটির অম্লাত্মক থেকে নিরপেক্ষ অবস্থা ধান চাষের অনুকূল।
- মাটিতে জৈব পদার্থ কম হলে কমপােস্ট ব্যবহার করে এর মাত্রা বাড়ানাে যায়।
- মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ, জিঙ্ক, সালফার ইত্যাদির মাত্রা নির্ধারণ করে। প্রয়ােজনীয় সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা যায়।
গম চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি গম চাষের জন্য উপযােগী। মাঝারি নিচু জমিতেও গম চাষ করা হয়।
- দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য ভালাে। এঁটেল। দোআঁশ মাটিতেও গমের চাষ হয়।
- বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলােতে গমের চাষ ভালাে হয়। এছাড়া ঢাকা, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুরেও গমের আবাদ হয়।
- বাংলাদেশের সব কৃষি অঞ্চলে গমের চাষ হয়। বিশেষ করে হাওর বাঁওড় ও বিল অঞ্চলে গমের আবাদ করা হয় না।
- যে মাটিতে pH (অম্লাত্মক-ক্ষারত্মক)। মাত্রা ৬.০ থেকে ৭.০ সেসব মাটিতে গম ভালাে হয়।
ডাল চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- উচু ও মাঝারি জমিতে দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ এবং পলি দোআঁশ মাটিতে ডাল জাতীয় ফসল জন্মে। ডাল ফসল অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারেনা। তাই নিষ্কাশনযােগ্য মাটিই ডাল চাষের জন্য উপযােগী ।
- ডাল নিরপেক্ষ বা ক্ষারীয় চুনযুক্ত মাটিতে ভালাে হয়।
- শুষ্ক ও ঠাণ্ডা আবহওয়া এবং অল্প বৃষ্টিপাত ডাল ফসল চাষের জন্য উপযােগী। যদি এরূপ আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত থাকে তবে বেলে দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ প্রকৃতির মাটিতে অবশ্যই ডাল ফসল ভালাে ফলন দিবে ।
- বিনা চাষে ডাল ফসল আবাদের জন্য নিচু ও মাঝারি জমি নির্বাচন করতে হবে। জমি থেকে বর্ষার পানি নেমে গেলে ভেজা মাটিতে ডাল ফসলের বীজ বােনা হয় ।
পাট চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি নদ-নদীর পলিবাহিত উর্বর সমতল ভূমিতে পাট ভালাে
- নদীবাহিত গভীর পলিমাটি পাট চাষের জন্য বিশেষ উপযােগী।
- দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতেও পাট ভালাে জন্মে।
সবজিঞ্জাতীয় ফসলের মাটির বৈশিষ্ট্য
সবধরনের শাকসবজিই উচু, সুনিষ্কাশিত দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, পলি দোআঁশ মাটিতে ভালাে জন্মে। নিচেআলু ও টমেটো চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলাে।
গােল আলু চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি আলু উৎপাদনের জন্য বেশ উপযােগী।
- আলুর জন্য বায়ু চলাচল করতে পারে এরূপ নরম ও ঝুরঝুরে মাটি দরকার। এতে আলু বড় হওয়ার সুযােগ পায় ।
- গােল আলুর মাটিতে প্রচুর জৈব পদার্থ থাকা দরকার।
- মাটির PH মাত্রা ৬-৭ এর মধ্যে থাকা ভালাে।
টমেটো চাষােপযােগী মাটির বৈশিষ্ট্য
- যে কোনাে প্রকার মাটিতে টমেটোর চাষ করা যায়। তবে বেলে ও কংকরময় মাটিতে টমেটো চাষ করা যায় না ।
- দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি টমেটো চাষের উপযােগী ।
- বেলে মাটিতে অধিক পরিমাণে জৈবসার প্রয়ােগ করলে টমেটোর চাষ মােটামুটি করা যায়।
- মাটির pH মাত্রা নিরপেক্ষ মাত্রার কাছাকাছি হলে ভালাে হয়।